Wednesday, July 6, 2022

১। অডিশান

 আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে চম্বলের। অ্যালার্ম বাজার আগেই। কাল বিকেলে ফোনটা আসার পর থেকেই মনটা বেশ চনমনে লাগছে ওর। অবশেষে কি সুযোগ এলো?

সিনেমায় নামার শখ চম্বলের ছোটবেলা থেকেই। বাবা মায়েরও আপত্তি নেই। কিন্তু চাইলেই তো আর অভিনেতা হওয়া যায় না। অভিনয় শিখতে হয় তার জন্য। নাটক করছে চম্বল ছোটোবেলা থেকেই, অনেকেই বলেন থিয়েটারই আসল অভিনয়ের জায়গা। কিন্তু চম্বলের স্বপ্ন রূপালী পর্দা। আর সেই কারণেই গত ছ’মাস ধরে কলকাতায় এসে থাকছে চম্বল। অভিনয় শেখার কোর্স করেছে কিছু। তার সাথে ডান্স ক্লাস, মডেলিং ক্লাস, রেগুলার জিম, জগিং, ডায়েটিং...কত্ত কিছু। দু’মাস আগে একটা অ্যাকটিং এজেন্সীতে নাম লিখিয়ে প্রতিক্ষায় ছিলো।

অবশেষে কাল বিকেলে এসেছে সেই বহু আকাঙ্খিত খবর। একটা অডিশান হবে অভিনেতাদের। সময় আজ বেলা এগারোটা। কি সিনেমা সেটা এখনো জানে না ও। গেলেই জানতে পারবে।

তারাতারি চান করে নেয় চম্বল। ওর ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম আছে। তারপর আলমাড়িটা খুলে জামাকাপড় বাছতে বসে। কি পড়ে যাওয়া যায়? বেশ কিছু ভেবে হলুদ টিশার্টটাই বার করে। বেশ উজ্জ্বল রঙ, ভালো খুলবে। তাছাড়া ওর গায়ের রঙ-ও বেশ ফর্সা। একটা নীল জিনসের সাথে হলুদ গেঞ্জিটা পড়ে নেয় চম্বল। সামনে পেছনে পারফিউম ছড়িয়ে ঘর থেকে বেরোয়।

বাইরে ডাইনিং এরিয়ায় মাটিতে একটা তক্তপোষ পেতে চম্বলের রুমমেট টিমো পড়াশুনো করছিলো। অর্থাৎ একগাদা বইখাতা ছড়িয়ে হাতে মোবাইল নিয়ে বসে ছিলো। চম্বল সামনে এসে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।

“কেমন লাগছে রে?” চম্বল জিজ্ঞাসা করে।

“মারকাটারি,” টিমো বলে। “হিরো হবি তুই।”

“হিরোর রোল পাওয়া অত সোজা নয়। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।” চম্বল একটা টুল টেনে বসে পকেট থেকে ফোন বার করে মা কে ফোন করে বাবার সাথেও কথা বলে   

ফোন রাখার পর টিমো বলে, টেনশান করিস না হিরোর রোল পাবি তুই।”

চম্বল পায়ে মোজা গলায়। “হিরোর বন্ধু বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র হলেও কোনো আপত্তি নেই। ভিলেন না বানালেই হল”।

“তোর চেহারার ছেলে কখোনো ভিলেন হয়?” টিমো হেসে বলে। “আমি যদি সিনেমায় নামতে চাইতাম, তাহলে আমার ভিলেনের রোল জুটতো।“

চম্বল মোজার ওপর জুতো গলিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

“গুড লাক,” টিমো থাম্বস আপ দেখায়। তারপর চোখ টিপে বলে, “মিষ্টির দোকান থেকে দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে যা। ইন্টারভিউ ব্যাপারটা পরীক্ষার মতই।“

“অডিশান, ইন্টারভিউ না,” চম্বল শুধরে দেয়। “চাকরিতে ইন্টারভিউ হয়, আর সিনেমায় অডিশান। যাই হোক, থ্যাঙ্ক ইউ। এবার বেরোই। আশা করি আজ মেট্রোয় কোনো গোলমাল হবে না।“

“মেট্রোয় করে সিনেমার অডিশান দিতে যাবি?” টিমো মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে।

“ওটাতেই সবচেয়ে তারাতারি হবে।“ চম্বল বেরিয়ে পরে।  

একটু পরে মেট্রোয় দাঁড়িয়ে ওর মনে হয় টিমোর কথাটা শোনা উচিৎ ছিলো। গাদাগাদি ভিড়ের ঠেলায় ওর সযত্নে ইস্তিরি করা গেঞ্জিটা প্রায় কুঁচকে যাবার পথে। যতটা পারা যায় ভিড় বাঁচানোর চেষ্টা করে চম্বল, কিন্তু এমনকি ভেস্টিবিউলের সামনেও চারটে লোক দাঁড়িয়ে। একটা ট্যাক্সি নিলেই ভালো হতো নাকি?

রাস্তায় উঠে এসে একটু খুঁজে নির্দিষ্ট বাড়িটার সামনে পৌঁছয় চম্বল একটা হালকা নীল রঙের বাড়ি, নীচটা দোকান, ওপরে ফ্ল্যাট ঠিকানা মিলে গেছে এবার তিনতলায় যেতে হবে

চম্বল জানে সব সিনেমা বা সিরিয়ালের শুটিং স্টুডিওয় হয় না অনেকে শুটিং এর জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া দেন আর শুটিং যদি হতে পারে, তো অডিশান হবে না কেন?

বাড়িটার একতলায় একটা বিউটি পার্লার আর একটা বসে খাওয়ার রোল চাউমিনের দোকান তার মাঝখানে সদর দরজা, ভেতরে ওপরে ওঠার সিঁড়ি চম্বল ঢুকে পড়ে, লিফটের তোয়াক্কা না করে সিঁড়ির দিকেই এগোয় তিনতলা আর এমন কি?

তাকে যেতে হবে - ফ্ল্যাট ডানদিকের ফ্ল্যাটগুলোর নম্বরএ’ আড়াইতলার ল্যান্ডিং- পৌঁছে চম্বল একবার দাঁড়ায় পকেট থেকে একটা ছোটো চিরুনি বার করে চুলে চালিয়ে নেয়। রুমাল দিয়ে একবার মুখটাও মুছে নেয় তারপর হাত দিয়ে গেঞ্জিটাকে একটু চেপে টানটান করে নিয়ে ওপরে উঠে আসে

কিন্তু তিনতলায় পৌঁছনোর আগেই হঠাৎ ডানদিকের দরজাটা খুলে যায় একজন লম্বা চওড়া চেহারার লোক বেরিয়ে এসে চম্বলের পাশ দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায়

এও কি অডিশান দিতে এসেছিল? অনেকেই আসবে নিশ্চয়ই কি তাহলে চম্বলের প্রতিদ্বন্দী?

লোকটি চম্বলকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেছিলো কয়েক ধাপ চম্বল ঘুরে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা, অডিশানটা কি ওই ফ্ল্যাটটার ভেতরেই হচ্ছে?”

লোকটি ঘুরে দাঁড়ায় এই প্রথম যেন চম্বলকে লক্ষ্য করলো তারপর বলে, “আপনি কি মিস্টার চ্যাটার্জি?”

তাহলে প্রতিদ্বন্দী নয় হয়তো যারা অডিশান নেবে তাদের কেউ অথবা যে এজেন্সির থেকে চম্বলকে এখানে পাঠিয়েছে তাদের লোক

“হ্যাঁ, আমি চম্বল চ্যাটার্জী।”

ওখানেই হচ্ছে,” লোকটি বলেআপনি ঢুকে যান

নেমে যায় লোকটি চম্বল শেষ কয়েকটা ধাপ উঠে দরজার সামনে দাঁড়ায় বেশ ভারি কাঠের দরজা চম্বল হালকা ঠেলে, দরজাটা খোলাই আছে দরজা খুলে ঘরের মধ্যে পা রাখে চম্বল

কিন্তু এক পা ঢুকেই থমকে যায় ঘরটা খালি একেবারেই খালি

আর কেউ আসেনি অডিশান দিতে?

চম্বল ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে বেশ বড় ঘরটা বসার ঘর হিসাবেই বানানো, কিন্তু সেরকম কোনো আসবাব নেই শুধু কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা একদিকে, আরেকদিকে একটা সোফাসেট, কেমন যেন বেমানান ঘরটার দুদিকেই দরজা আছে দুটি করে কিন্তু সবকটাই বন্ধ চম্বল একটু ইতস্তত করে ডানদিকের একটা দরজার দিকে এগোয়, হাতলে চাপ দিয়ে খোলার চেষ্টা করে কিন্তু দরজাটা বন্ধ ডানদিকের বাকি দরজাটা  খোলা গেলো, কিন্তু সেটা একটা বাথরুম

চম্বল এবার বাঁদিকের দরজাটা খোলার চেষ্টা করে, বাথরুমের উল্টোদিকেরটা বন্ধ

বেশ সন্দেহজনক ব্যাপার। চম্বলের অস্বস্তি হতে থাকে ছেড়েছুড়ে চলে যাবে নাকি? কিরকম অডিশান রে বাবা!

খানিকটা কৌতুহলের বশেই চতুর্থ দরজাটা খোলার চেষ্টা করে চম্বল এটা একবারেই খুলে যায়দরজার ওপারে একটা ঘর।

ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল গোটা দুয়েক কাঠের চেয়ার সেই টেবিলে বসে এক ভদ্রলোক একটা খবরের কাগজে ডুবে আছেন ঘরে আর দুটো কাঠের আলমাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই চম্বল এক পা ঢোকে ভদ্রলোকের কোনো হুঁশ নেই, মগ্ন হয়ে আছেন খবরের কাগজে কি কাগজ বুঝতে পারে না চম্বল তবে একটা বাংলা কাগজ, পাতাগুলো লেখা্য় ঠাসা, সামান্য কয়েকটা সাদাকালো ছোটো ছবি এদিকে ওদিকে

ভদ্রলোকের পরনে  একটা সাদা পাঞ্জাবী, সোনার বোতাম লাগানো নাকের ওপরে একটা সোনালী ফ্রেমের চশমা, ডাঁটির সাথে কালো দড়ি বাঁধা মাথায় বেশ ঘন চুল

চম্বল খোলা দরজার ওপরেই নক করে

ভদ্রলোক চমকে উঠে তাকান তারপর সোজা হয়ে বসেন টেবিলের ওপরে রাখা আরেকটা কি কাগজের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চম্বলকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি চম্বল চ্যাটার্জি? আসুন

চম্বল এগিয়ে যায় ভদ্রলোক খবরের কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের নিচে একটা ড্রয়ারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেন, “আমার নাম মহিমরঞ্জন সরকার নমস্কার বসুন

চম্বল টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে বসে আড়চোখে দেখে টেবিলের ওপর তার বায়োডেটাটা রাখা রয়েছে ভদ্রলোক সেটা দেখেই ওর নাম বলেছিলেন ঠিক যায়গাতেই এসেছে কিন্তু আর কেউ নেই কেন? কিরকম সিনেমার রোল যেখানে আর কেউ অভিনয় করতে চায় না?

চম্বল আপনার ভালো নাম?” মহিমরঞ্জন জিজ্ঞাসা করেন

হ্যাঁ

চম্বল এতে অভ্যস্ত ওর নাম শুনলে অনেকেই অবাক হন আসলে চম্বলের বাবা ছিলেন ডাকাত-ভক্ত চম্বলও ছোটোবেলা থেকে শুধু ডাকাত আর জলদস্যুর গল্প শুনে বড় হয়েছে চম্বল সেকথাটা বলে মহিমবাবুকে

ডাকাত-ভক্ত বলে ছেলের নাম দিয়েছেন চম্বল?” মহিমবাবু হেসে ওঠেনবেশ, বেশ তাহলে পুলিশ ভক্ত হলে কি নাম দিতেন লালবাজার চ্যাটার্জি?”

নামটা বদলানো যেতে পারে কিন্তু,” চম্বল বলেআমি এজেন্সীকেও জানিয়েছিলাম সিনেমায় তো অনেকেই নতুন নাম নেয়

সিনেমা, হুম,” মহিমরঞ্জন স্বগতক্তি করেন তারপর হঠাৎ চম্বলের বায়োডেটাটা টেনে নেন কাছে পাতা উলটে দেখেন কিছুক্ষণ জানতে চান, “এইখানে এই যে সব লিখেছেন, এগুলো আপনি সত্যিই পারেন? ফেন্সিং, লাঠি খেলা, ঘোড়ায় চড়া?”

হ্যাঁ

কোথায় শিখেছেন?”

লাঠি খেলাটা বাবার কাছে, ফেন্সিং খানিকটা বাবার কাছে, তারপরে একটা ক্লাবে আর ঘোড়ায় চড়াটা বাবার এক বন্ধুর কাছে

আপনার বাবা তো নমস্য ব্যক্তি লাঠি, তরোয়াল, সব চালাতে জানেন ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করার ইচ্ছা রইল

আসলে ডাকাতরা তো ওইসবই করতো,” চম্বল বলে

পুরনো যুগে ওইসব সবাইকেই করতে হতো যাই হোক, আপনার এই গুণগুলি আমি একটু পরীক্ষা করে দেখতে চাই মানে, লাঠিখেলা আর ফেন্সিং

ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে ওঠেন চম্বল লক্ষ্য করে যে, উনি শুধু পাঞ্জাবীই নয়, সঙ্গে মালকোচা মারা ধুতিও পড়ে আছেন

আচ্ছা, এই সিনেমাটা কি পুরোনো যুগের গল্প নিয়ে? মানে পিরিয়ড পিস?” চম্বল জানতে চায়

কিন্তু মহিমবাবু ততক্ষণে একটা আলমাড়ি খুলে কি সব বার করতে লেগে পড়েছেন অন্যমনস্ক ভাবে বলেন, “পুরোনো যুগের গল্প? হ্যাঁ, সেরকমই অনেকটা

ঝনাৎ করে আওয়াজ হয় ভদ্রলোক মাটিতে কিসব নামিয়ে রেখেছেন তারপর আরো খানিকটা ঝনাৎ ঝনাৎ খট খট এর পর আলমাড়ির দরজাটা ঠেলে বন্ধ করেন কোমরে হাত দিয়ে মাটির দিকে ঈশারা করে বলেন, “এগুলো ছাদে নিয়ে যেতে হবে

চম্বল চেয়ার ছেড়ে উঠে মাটিতে রাখা জিনিসগুলো দেখে দুটো তলোয়ার আর দুটো মোটা লাঠি ওকে পরীক্ষা করার জন্য এসব জোগাড় করেছে নাকি এরা?

মহিমবাবু ইতিমধ্যে আরেকটা আলমাড়ি খুলে কিসব ঘাঁটতে লেগে গেছেন একটা সাদা চাদর বার করে চম্বলকে দেখান বলেন, “এটা দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে যাই হঠাৎ করে কারুর সাথে দেখা হয়ে গেলে সে হাতে তরোয়াল দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারে কি বলেন?”

চম্বল আর কি বলে? মাথা নাড়ে তারপর জিজ্ঞাসা করে, “ছাদে যেতে হবে কেন?”

এখানে জায়গা নেই তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলে দেওয়ালে লেগে যাবে, আসবাব নষ্ট হবে

মহিমবাবু চাদরটা দিয়ে তলোয়ার আর লাঠিগুলোকে মুড়িয়ে বগলদাবা করেনআসুন, চম্বলবাবু

চম্বল ওনার পিছন পিছন বেরোয় বাইরের ঘরটা এখনো খালি সত্যিই কি আর কেউ অডিশান দেবে না? কি সিনেমার কি রোলের অডিশান, সেটা তো এখনো জানতে পারলো না ডায়ালগ বলানোর আগে অ্যাকশান করিয়ে দেখতে চাইছে শেষে কি এরা ওকে স্টান্টম্যান বানাতে চাইবে?

মনের চিন্তা মনেই রেখে চম্বল মহিমরঞ্জনের পিছনে চলতে থাকে সিঁড়িটা খালিই ছিলো দুজনে ছাদে পৌঁছয়

ছাদটা বেশ প্রশস্ত ধার ধরে সারি দিয়ে ফুলের টব বসানো মাঝখানটা অনেকটা খালি জায়গা মাথার ওপরে একটা সবুজ আধা-স্বচ্ছ প্লাস্টিকের চাল মহিমবাবু সেই চালের নিচের সবুজ রদ্দুরের মধ্যে চম্বলকে দাঁড়াতে বলেন হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে চাদরটা খুলে ফেলেন একটা তলোয়ার তুলে হঠাৎ চম্বলের দিকে ছুঁড়ে দেন

চম্বল নিয়মিত খেলাধুলো করে তার রিফ্লেক্স ভালোই। তাই তলোয়ারটা লুফে নেয় একবারেই কিন্তু আরেকটু হলে হাত থেকে পড়ে যেত কারণ তলোয়ারটা ভারি বিষম ভারি

এটা তো আসল তলোয়ার!” চম্বল বলে ওঠে

মহিমবাবু এবার বাকি তলোয়ারটা হাতে নিয়ে চম্বলের মুখোমুখি দাঁড়ান বলেনঅবশ্যই একেবারে রিয়েল সোর্ড যুদ্ধ কি আর নকল তলোয়ার দিয়ে হয়?”

কিন্তু আমাকে তো আসল যুদ্ধ করতে হবে না!” চম্বল বলে ওঠে কি পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে!

কিন্তু মহিমরঞ্জন ওসব কথাকে পাত্তাই দেননা তিনি ধুতিটা একটু কষে বেঁধে নিয়ে তলোয়ারটা দু’হাত দিয়ে ধরেন

চম্বল লক্ষ্য করে যে মহিমবাবুর তলোয়ার ধরার পদ্ধতি একেবারে নিখুঁত তলোয়ার খেলা ইনি জানেনআসুন চম্বলবাবু, প্রথমে আপনি আক্রমন করুন

চম্বল সাবধানে তলোয়ার চালায়। মহিমরঞ্জন তাচ্ছিল্যের সাথে আটকে দেন। বলেন, “আরেকটু জোরে।”

চম্বল পরের আক্রমনে আরেকটু জোর দেয়। কিন্তু মহিমরঞ্জন একই ভাবে তাকে থামিয়ে দেন। “আরেকটু আগ্রাসন প্রয়োজন, চম্বলবাবু।”

বিরক্ত হয় চম্বল। দু’হাতে ভালো করে ধরে তলোয়ারটা, চালায় মহিমরঞ্জনের হাত লক্ষ্য করে। আবার থামান মহিমরঞ্জন। “আগের থেকে ভালো, তবে আপনি একটু বেশি সতর্ক।””

“লেগে যেতে পারে স্যার,” চম্বল বলে।

“তলোয়ার যুদ্ধ এটা চম্বলবাবু। এক্কা দোক্কা খেলা নয়। লাগতেই পারে। এবার তাহলে আমি আক্রমন করি।”

এই রে! এ কি মারতে আসবে নাকি? চম্বল তরিঘরি তলোয়ারটা বাগিয়ে ধরে। এবং মহিমরঞ্জন আক্রমন করেন। চম্বল ঠেকাতে থাকে। খেলার জন্য যতটা, তার থেকে বেশি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। কারণ মহিমরঞ্জনের চম্বলের হাত লক্ষ্য করে নয়, গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাচ্ছেন।

হঠাৎ থেমে যান মহিম। বলেন, “আপনার রক্ষণটা ভালোই। এবার আক্রমনটা পরীক্ষা করা দরকার। আসুন, মারুন।”

চম্বল বলে, “দেখুন স্যার, বাই চান্স যদি লেগে যায়, তাহলে আমাকে পুলিশ…”।

মহিমরঞ্জন হাসেন। “আমাকে তলোয়ার খেলায় আহত করার ক্ষমতা আপনার নেই।”

“শুনুন, আমি ছোটবেলা থেকে ফেন্সিং শিখছি। অনেক প্রাইজ ও পেয়েছি।”

“তাহলে এত ভয় কিসের?”

চম্বলের কান লাল হয়ে যায়। মহিমরঞ্জন পাগল হতে পারেন, কিন্তু তাবলে এরকম অপমান করবেন? চম্বলের নাম কি এমনি  এমনি চম্বল? কত ডাকাতের কত বিরত্বের  কাহিনী তার নামের পেছনে।

ঝাঁপিয়ে পড়ে চম্বল। তার প্রতিপক্ষ অত্যন্ত পারদর্শি, অল্পেই টের পায়। কিন্তু হাল ছাড়ে না। তরোয়ালের ঠং  ঠং আওয়াজ এ রাস্তার গাড়ির আওয়াজ চাপা পড়ে যায়।

একটা সময় চম্বল দেখে যে সে তার প্রতিপক্ষকে আস্তে আস্তে কোনঠাসা করে ফেলছে। নবদ্যমে আক্রমন শানায় ও। মহিমরঞ্জন বাঁচাতে থাকেন। দুর্বার সেই রক্ষণ, কিন্তু পিছোতে বাধ্য হচ্ছেন ভদ্রলোক। একটা সময় আর পিছনোর জায়গা থাকে না। চম্বল তরোয়াল তুলে বলে, “আত্মসমর্পন?”

মহিমবাবু হাসেন।

তারপরে এক লহমায় তিনি চম্বলের উদ্যত তরোয়ালকে ঠেলে নিচে নামিযে বিদ্যুৎবেগে চম্বলের সামনে থেকে পেছনে চলে আসেন। চোখের পলক ফেলার আগেই চম্বল দেখে সে মহিমরঞ্জনের কবলে এবং মহিমরঞ্জনের তরোয়াল তার গলার থেকে আধ ইঞ্চি দূরে স্থির হয়ে আছে।

“আত্মসমর্পন?” চম্বলের পেছন থেকে মহিমরঞ্জন বলেন।

তবে চম্বলের উত্তরের অপেক্ষা করেননা তিনি। প্রয়োজনও নেই। চম্বলকে ছেড়ে দেন। ওর তরোয়ালটা নেবার জন্য হাত বাড়ান।

চম্বল বুঝতে পারেনা কি হলো। ওর কোনো ভুলের জন্য কি মহিমরঞ্জন ওকে হারিয়ে দিলেন নাকি পুরো সময়টাই মহিমরঞ্জন চাইলে ওকে পরাস্ত করতে পারতেন, পিছোতে থাকাটা পুরোটাই একটা খেলা ছিলো? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, ও কি তাহলে ইন্টারভিউতে ফেল করলো?

কিসের জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছে, সেটাও যদি একবার বুঝতে পারতো।

এদিকে মহিমরঞ্জন তরোয়ালদুটো নামিযে রেখে একটা লাঠি নিযে উপস্থিত হয়েছেন। একটাই লাঠি। সেটা ধরিয়ে দেন চম্বলকে। বলেন, “একটু লাঠি খেলা দেখান।”

“আপনি খালি হাতে লড়বেন নাকি?” চম্বল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন।

মহিমরঞ্জন হেসে ওঠেন। বলেন, “না, না। লড়াই হয়ে গেছে, আর লড়ব না। আপনি একটু লাঠির খেলা দেখান, আমি দর্শক হয়ে দেখি।”

চম্বল বোঝে এটাও একটা পরীক্ষা। কিন্তু এতে তার চিন্তার কিছু নেই। লাঠি নিয়ে কসরত চম্বল ভালোভাবেই শিখেছে, এবং থেকে থেকে করেও থাকে। কখনো নিজের অভ্যেস রাখার জন্য, কখনো বন্ধুদের দেখানোর জন্য।

স্বছন্দে লাঠির খেলা দেখায চম্বল। শেষে মহিমবাবু বলেন, “বাহ, চমৎকার। ভালোই শিখেছেন লাঠি খেলা। আজকের দিনে বেশ দুর্লভ।”

দুজনে নেমে আসেন ছাদ থেকে। বাইরের ঘরটা এখনো খালি। মহিমরঞ্জনের পেছনে পেছনে চম্বল ভেতরের ঘরটাতে এসে বসে। মহিমরঞ্জন তরোয়াল এবং লাঠি আবার আলমাড়িতে ঢুকিয়ে রেখে চম্বলের উল্টোদিকে তাঁর চেয়ার টেনে বসেন। তারপর বলেন, “আপনি তরোয়াল যুদ্ধে ভালোই পারদর্শী।”

“কিন্তু পরাস্ত হলাম।”

সেটাকে খুব একটা পাত্তা দেননা মহিমরঞ্জন। বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা আপনার থেকে অনেক বেশি। কিন্তু আপনি যথেষ্ট ভালো যোদ্ধা।”

যোদ্ধা? না খেলোয়াড়? চম্বল ঘাঁটায় না। তার বদলে জানতে চায়, ও চান্স পাবে কিনা।

মহিমরঞ্জন জানতে চান কিসের চান্স।

“যে সিনেমাটা আপনারা বানাচ্ছেন, তাতে কি আমি চান্স পাবো?” পরিস্খার করে জিজ্ঞাসা করে চম্বল।

“আমরা কোনো সিনেমা বানাচ্ছি না।”

কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে চম্বল। তারপর ঢোক গিলে বলে, “কিন্তু আমি তো সিনেমার অডিশান দিতে এসেছি।”

“ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। আসলে আমাদের কাজের জন্য যেরকম লোক দরকার, মানে এই লাঠি তরোয়াল ঘোড়ায় চড়ায পারদর্শি, সেরকম লোক এমনি কোথা থেকে পাবো, বলুন? তাই আমরা অনেক জায়গায় খোঁজ করি। যারা সিনেমায় নামতে চায়, তারা এসব শেখে। সিনেমায় মারামারি করতে দরকার পরে। আপনাকেও সেভাবেই পেয়ে গেলাম।”

মহিমরঞ্জন চম্বলের বায়োডাটার ওপরে একটা ফাউন্টেন পেন দিয়ে খসখস করে কিসব লেখেন। তারপর বলেন, “আপনি মনোনিত হয়েছেন এবং চাকরিটা পেয়ে গেছেন।”

চাকরি পেয়ে গেছে মানে? চম্বল মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না। বুঝতে চায়ও না। সোজা উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। বলে, “আমি চাকরি করতে চাই না, আমি সিনেমার হিরো হতে চাই।”

“হবেন তো হিরো, অবশ্যই হবেন। কিন্তু কালকেই তো আর হবেন না? সুতরাং কালকে আপনি বেলা এগারোটায বারুইপুর স্টেশানের বাইরে চলে আসুন। তারপরে না হয় পরশু থেকে আবার সিনেমা খুঁজবেন।”

“বারুইপুর? আপনাদের কোম্পানির নাম কি?”

“নামে কি বা আসে যায়?”

“তার মানে?” চম্বল বুঝতে পারে না। “নাম একটা থাকবে নিশ্চয়ই। আর কাজটাই বা কি? কি করতে হবে?”

“সব কালকেই জানতে পারবেন,” মহিমরঞ্জন বলেন।

“আমি একাই ইন্টারভিউ দিতে এসেছি? আর কোনো ক্যানডিডেট নেই?”

“না, আমরা আর কাউকে ডাকিনি।”

চম্বল প্রবল দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিকে হাতে একটা চাকরি পেয়ে গেছে, সেটা ছেড়ে দেয় কিকরে? অপরদিকে ব্যাপারস্যাপার খুবই বিচিত্র।

মহিমরঞ্জন বোধহয় বুঝতে পারেন। বলেন, “চিন্তা করবেন না। আমরা আপনাকে বিপদে ফেলবো না।”

“আমরা মানে?” চম্বল জিজ্ঞাসা করে। “আপনারা কারা?”

“সেটাও কালকেই জানতে পারবেন। তাহলে ওই কথাই রইল। বারুইপুর স্টেশানের বাইরে বেলা এগারোটায় দেখা হচ্ছে।”

এরপরে আর থাকার মানে হয় না। চম্বল বেরিয়ে পরে।

 

সন্ধেবেলায় বাড়িতে টিমোকে সব খুলে বলে চম্বল। বন্ধুর মুখ দেখে টিমোর আর বুঝতে বাকি ছিলো না, যে তার বন্ধু হিরোর রোল পেয়ে যায়নি। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে চম্বল দুঃখ পেতে পারে বলে কিছু বলেনি। এখন সব কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যায় টিমো। বলে, “লাঠি তরোয়াল জানা প্রয়োজন, অথচ সিনেমার জন্য নয়? তাহলে কিসের জন্যে?”

“শুধু তাই নয়। কথাবার্তা শুনে মনে হলো সত্যি সত্যি লড়াই করার প্রয়োজন হতে পারে। শেষে কি ডাকাত দলের পাল্লায় পড়লাম নাকি?”

টিমো হেসে বলে, “তাহলে তোর নামটা সার্থক হবে।”

চম্বল বলে, “কি করি বল তো? কাল যাবো?”

টিমো একটু ভাবে। বলে, “আমি বলবো ঘুরে আয়। বেলা এগারোটায় বারুইপুর স্টেশানের বাইরে তোর কি বিপদ ঘটতে পারে? তবে মাঝে মাঝে আমাকে একটা করে মেসেজ করে দিস। বিশেষ করে যদি ওখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যায়। গাড়ি থাকলে গাড়ির নাম্বারটা মেসেজ করে রাখিস। বুঝলি তো?”

চম্বল পায়চারি করতে থাকে। বলে, “বুঝে গেছি। গাড়ির নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, জায়গার নাম, এগুলো তোকে জানিয়ে দেবো।” হাত দুটো কচলে নিয়ে বলে, “বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছে কিন্তু।”

“মাথা ঠান্ডা রাখিস। তুই আবার যা অস্থির!”

চম্বল এক গাল হাসে। বলে, “শান্ত ঠান্ডা হয়ে বসে থাকা আমার ধাতে নেই। নামটা চম্বল। তার একটা কারণ আছে।”